অর্থনীতির জগতে সাধারণত হিসাব-নিকাশের ব্যাপারগুলো খুবই নিরাবেগ ও গাণিতিক। তবে সেই শুষ্ক আর সংক্ষিপ্ত হিসাবের মাঝে প্রাণের স্পর্শ এনে দিয়েছেন ব্যাংকার রকিবুল হাসান সবুজ। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যাংকিং কেবল টাকার লেনদেনের বিষয় নয়; এটি বিশ্বাস, সম্পর্ক ও আনন্দের বিনিময়ের এক অমূল্য সুযোগ।
এনআরবিসি ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শাখায় নিজের কর্মস্থলে বসে তিনি গড়ে তুলেছেন এক নতুন ধরণের ব্যাংকিং সমাধান—‘আনন্দময় ব্যাংকিং’। যেখানে কর্মী ও গ্রাহক উভয়ের জন্যই ব্যাংক মানে শুধু হিসাবের স্থান নয়, বরং এটি একটি আস্থা ও আনন্দের উৎসব। ২০২২ সালে এনআরবিসি ব্যাংক তাকে ‘সেরা পারফরমার’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করে—যা একদিকে তার ব্যক্তিগত কৃতিত্ব, অন্যদিকে ব্যাংকিংয়ে সৃজনশীলতার জয়গান বলে স্বীকৃতি পায়।
ব্যাংকটির কিশোরগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক ও এরিয়া ইনচার্জ রকিবুল হাসান সবুজ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্যাংকিংকে সহজ, আন্তরিক, মানবিক ও সৃজনশীলতার আবহে রূপ দিতে তিনি অনেক কাজ করেছেন। এসব উদ্যোগ শুধু সংখ্যার বাইরে গিয়ে সমাজের মনোভাব ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংকিং আমি কখনও কেবল সংখ্যার খেলা হিসেবে দেখি নি। প্রতিটি লেনদেনের পেছনে রয়েছে একজন মানুষ, তার স্বপ্ন, তার অবদান। আমার কাছে ব্যাংক মানে সেই মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্র। আমি চেয়েছি—যখন গ্রাহক ব্যাংকে আসেন, তখন যেন মনে করেন তিনি কেবল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নয়, বরং বিশ্বাসের জায়গায় এসেছেন। তাই আমাদের ব্যাংকিং হতে হবে হৃদয়স্পর্শী ও উপভোগ্য। এই ভাবনা থেকেই শুরু করি ‘আনন্দময় ব্যাংকিং’ এর পথচলা।
তিনি আরও জানান, তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যাংককে সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত করা। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন—করিমগঞ্জের প্রান্তিক বাঁশ-বেত কারিগরদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম দিনে ঋণ বিতরণ করাটা শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা নয়, ছিল এক সম্মানের প্রকাশ, শত বছরের ঐতিহ্যের স্বীকৃতি।
বাঁধা ছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুরুতে কিছু প্রশ্ন এসেছিল। কিন্তু যখন সহকর্মীরা দেখলেন, গ্রাহকদের মুখে হাসি, কর্মপরিবেশে উচ্ছ্বাস এবং সমাজে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া—তখন সবাই এটিকে নিজের উৎসব হিসেবে গ্রহণ করলেন। আজ ব্যাংকও আমাদের উদ্যোগের প্রশংসা করছে। তিনি বলেন, ‘যদি উদ্দেশ্য সত্যিই ভালো হয়, তবে প্রতিটি প্রচেষ্টা তার নিজস্ব পথ খুঁজে নেয়।’
রকিবুল হাসান সবুজ বলেন, বর্তমানে মানুষের মধ্যে আস্থা কমে যাচ্ছে—প্রতিষ্ঠান ও সম্পর্কের ওপর। এই সময় যখন বিশ্বাস হারাচ্ছে, তখন যদি ব্যাংকগুলো বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে উঠে দাঁড়ায়, তাহলে সমাজে নতুন ভারসাম্য ও সুবিধা সৃষ্টি হবে। মানুষ বলবে, ‘ব্যাংক মানে নিরাপত্তা, ব্যাংকার মানে বিশ্বাস।’ এই বিশ্বাস ফিরে পাওয়া আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, যা পারস্পরিক মূল্যবোধের ব্যাংকিংই সম্ভব করে তুলবে বলে তিনি মনে করেন।
নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত কথাও তিনি গুরুত্বসহকারে বলেন। তাঁর মতে, প্রত্যেকেরই অর্থনৈতিক স্বার্থ ও অস্তিত্ব রয়েছে। ডিম বিক্রেতা, চা বিক্রেতা বা রিকশাচালক—তাদের লেনদেনই দেশের অর্থনীতির প্রাণ। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাটা শুধু টাকা জমা দেওয়ার বিষয় নয়, তা হলো আত্মসম্মানের স্থান। প্রথম ডিম বিক্রেতা যাতে আর তার নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, সেটাই ছিল তার জন্য অনেক বড় অর্জন, যা তাকে বোঝায়—ব্যাংক শুধু টাকা রাখার স্থান নয়, এটি একটি আস্থার স্থান।
‘সেরা পারফরমার’ হওয়ার বিষয়েও তিনি বলেন, এটি সত্যিই একটি বড় প্রেরণা, কিন্তু সেটিকে তিনি ব্যক্তিগত স্বীকৃতি হিসেবে দেখেন না। এটি তার দলের সকলের জন্য গৌরবের বিষয়। তাঁর সতীর্থরা যে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও উচ্ছ্বাস নিয়ে কাজ করেন, সেই努力ই এই পুরস্কারকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। সৃজনশীল ও আনন্দময় ব্যাংকিংয়ের যাত্রায় তিনি এটা একটি সুন্দর স্বীকৃতি মনে করেন।





