শুক্রবার, ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গুমেরও বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা যাবে জোরপূর্বক গুমের অপরাধের। আগে গুম সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার আইনটি সংশোধন করে এই আইনে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।

একই সঙ্গে শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও আনসার বাহিনী এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট কোনো বাহিনী ও বাহিনীর সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করে আনা হয়েছে বিচারের আওতায়। সংশোধনীর আগে ১৯৭৩ সালে প্রণীত এই আইনে শৃঙ্খলা বাহিনী হিসাবে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন এই তিন বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সংশোধনীতে।

জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’স আইনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়। ঐ সংশোধনী বুধবার অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনের পর রবিবার এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে সংশোধনী কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে। এখন সংশোধনী অধ্যাদেশ অনুযায়ী জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। একই সঙ্গে গত দেড় দশকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যেসব গুমের অপরাধ সংঘটন হয়েছে সেসব বিচারের আওতায় আসবে।

এছাড়া এই আইনে দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে বিচারে আওতায় আনা যেত। সংশোধনীর ফলে এখন শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, বিদেশে বসে যদি এই আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটন করে তাকেও বিচারের আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, এই সংশোধনীর ফলে আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে মামলার উভয় পক্ষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সুযোগের সমতা নিশ্চিত হয়েছে।

সংশোধনী অধ্যাদেশে অপরাধের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়েছে। এতে অপহরণ, দাসত্ব, বন্দি নির্যাতন, জোরপূর্বক নির্বাসন, যৌন নিপীড়ন, গুম, মানব পাচার, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, গর্ভধারণ বা বন্ধ্যাত্বকরণকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া কোনো জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক, জাতিগত বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আক্রমণ, নিপীড়নকেও অপরাধের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে ট্রাইব্যুনালের বিচারের আওতায় আনা যাবে। আন্তর্জাতিক রোম সংবিধি সনদে এগুলো অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ এই রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করে এসব অপরাধকে অনুমোদন দিয়েছে।

সংশোধনীর ফলে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে যে কোনো স্থানে তল্লাশির ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে এই তল্লাশি চালাতে পারবেন। ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে বিচারের যে কোনো পর্যায়ে অতিরিক্ত সাক্ষী ডাকতে পারবে প্রসিকিউশন। শুনানির যে কোনো পর্যায়ে অডিও-ভিডিও রেকর্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রত্যক্ষ করতে পারবে জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন সংস্থা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা। অধ্যাদেশে সেই সুযোগ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে ট্রাইব্যুনালে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন আসামিরা। বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের বিষয়টি অযৌক্তিকভাবে আটকানো যাবে না বলেও অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।

অডিও-ভিডিও রেকর্ডিং, ইলেকট্টোম্যাগনেটিক, অপটিক্যাল বা কম্পিউটার মেমরিতে সংরক্ষণ করা, ডিভিডি, সিসিটিভি ফুটেজ সাক্ষ্য হিসাবে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করার সুযোগ রাখা হয়েছে। আইনজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এছাড়া উপযুক্ত মনে করলে অপরাধের শিকার ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারবে ট্রাইব্যুনাল। দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির সম্পদ থেকে এই ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়েছে।

এছাড়া ট্রাইব্যুনাল অবমাননা সংক্রান্ত দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলে বিধান এই অধ্যাদেশে যুক্ত করা হয়েছে। আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। ঐ আপিল নিষ্পত্তির জন্য ৩০ দিন সময় বেধে দেওয়া হয়েছে এতে। ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপিল করলেও তা ট্রাইব্যুনালের বিচারের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে না।

ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীদের সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা এই অধ্যাদেশ বলা হয়েছে। এছাড়া প্রসিকিউশন, ডিফেন্স বা সাক্ষীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল সুরক্ষার বিষয়ে কার্যকর আদেশ দিতে পারবে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম সাংবাদিকদের বলেন, এই সংশোধনীতে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে। আগে শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে অপরাধ করলে এ আইনে বিচার করা হতো। এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে অথবা দেশের বাইরে থেকে অপরাধ করলে তার বিচার করা যাবে।

পোস্টটি শেয়ার করুন