মঙ্গলবার, ২১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের কয়েকটি দিক

ইসরায়েলের কারাগারে আট মাস বন্দি থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন ফিলিস্তিনি তরুণ মাহমুদ আবু ফউল, তবে তাঁর জন্য এটি ছিল এক অন্ধকার দুঃস্বপ্নের মতো সময়। তার মায়ের গলা শুনে তাঁর মন যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে, কিন্তু চোখে মায়া ভরা সেই মুখটা দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। মাহমুদ বয়স ২৮ বছর, গাজা এলাকার উত্তরে থাকতেন। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইসরায়েলি বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে কামাল আদওয়ান হাসপাতালে। এরপর থেকে তিনি ইসরায়েলি কারাগারে confinement এ ছিলেন। বন্দিশালার জঘন্য পরিস্থিতি আর নির্যাতনের কারণে তাঁর দৃষ্টি হারিয়ে গেছে।

গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় এ সপ্তাহে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁদের অনেকের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। মাহমুদ ২০১৫ সালে ইসরায়েলের হামলায় পা হারান। তিনি জানান, বন্দি থাকার সময় নানা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁকে রাখা হয়েছিল সেদেেইমান কারাগারে, যা ইসরায়েলের অন্যতম কুখ্যাত কারাগার হিসেবে পরিচিত। সেখানে অন্য অনেক বন্দিও ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

মাহমুদ বলেছেন, কারাগারে তার উপর জোরে আঘাত হানো হয়, যার কারণে তিনি অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি আরও জানান, তার মাথায় এতই জোরে আঘাত করা হয় যে তিনি unconscious হয়ে যান। তার ভাষায়, ‘আমি বারবার চিকিৎসার জন্য বলতাম, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কেমন যেন উদাসীন থাকত। চোখে ড্রপ দেওয়া, পানি পড়া, ব্যথা হওয়া—all আর কিছুই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।’ তিনি চিকিৎসার জন্য অনশনে বসার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেননি।

অবশেষে মুক্তি পেয়ে মাহমুদ নাসের হাসাপাতালে পাঠানো হয়। তিনি পরিবার দেখে খুব উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষার শেষ শেষে তার মা এসে তার কণ্ঠস্বর শুনে অট্টহাসি দিয়ে আবেগে ভরে উঠলেন। মাহমুদ তার ভাষায়, ‘তার (মায়ের) গলা শুনে আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমি তাকে দেখতে না পারলেও তার কণ্ঠস্বর আমার জন্য পৃথিবীর সবকিছু থেকে মূল্যবান।’

বর্তমানে মাহমুদ গাজায় বাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছে একটি তাবুতে বসবাস করছেন। তার চোখের চিকিৎসা এখনও হয়নি এবং তিনি বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়েছেন।

ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর পদ্ধতিগত নির্যাতনের প্রমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাহমুদের নিজের বর্ণনা এবং বন্দিদের শরীরে পাওয়া চিহ্নসমূহ এই বিষয়টির প্রমাণ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় অনেক বন্দির শরীরই দাগ-আঘাতে আক্রান্ত, কেউ কেউ অর্ধেক ওজনের হয়ে গেছেন।

প্যালেস্টিনিয়ান হিউম্যান রাইটস কার্পোরেশন ২০২৩-২০২৪ সালের মধ্যে বন্দি থাকা ১০০ জন মূল ফিলিস্তিনি বন্দির সাক্ষ্য সংগ্রহ করে দেখেছে, কোনোটিতে স্পষ্ট নির্যাতনের আলামত পাওয়া গেছে। তারা দেখেছে, ইসরায়েলের সব কারাগারে পদ্ধতিগতভাবে বন্দিদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এ ছাড়া বন্দিদের বিচারক, আইনজীবী বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ কম দেওয়া হয়, ফলে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়।

তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল অন্তত ১০০ জন ফিলিস্তিনির মৃতদেহ ফিরিয়ে দিয়েছে, যারা বন্দি থাকাকালে মারা গেছেন। গাজার হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মৃত্যুর বেশির ভাগই অস্বাভাবিক, কিছুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৭৫ জন ফিলিস্তিনি বন্দি ইসরায়েলি কারাগারে মারা গেছেন।

ইসরায়েলের মানবাধিকার সংগঠন বেইতসালেম গত বছর জানিয়েছে, কারাগারগুলো ‘নির্যাতনের জাল’—এখানে বন্দিদের ওপর নির্মম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন পদ্ধতিগতভাবে চালানো হয়। সেখানে খাবার ও চিকিৎসা সংকট রয়েছে, পাশাপাশি যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে।

পাবলিক কমিটি এগেইনস্ট টর্চার ইন ইসরায়েল (পিসিএটিআই) জানায়, ২০২৩ সালে বন্দি নির্যাতনের শতাধিক ঘটনা তিনি ডকুমেন্ট করেছেন। এর মধ্যে কেবল দুটি ঘটনা আইনি পদক্ষেপে নেওয়া হয়েছে, কেউই দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ শিবিরের রিপোর্ট মনোভাব বোঝায় যে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও, নির্যাতনের ঘটনা গোপন বা উপেক্ষা করা হয়েছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন