শনিবার, ৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তার কথা শুনলেই মন প্রশান্তিতে ভরে যায়

আলী যাকের ছিলেন বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী একজন অসাধারণ ব্যক্তি। বাংলাদেশের নাট্যজগতে তিনি নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত। ঢাকায় দর্শকদের বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের সূচনা করেছিলেন তিনি, যা ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। অভিনয় ও নির্দেশনায় তিনি যোগ করেছিলেন নতুন মাত্রা, যার জন্য তার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল বিশেষ স্থান। এই গুণী অভিনেতার জন্মদিন ছিল বৃহস্পতিবার, তিনি ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।

আলী যাকেরের হাত ধরে অনেক তরুণ নাট্যশিল্পী উঠে এসেছেন। তারা আজ দেশের নাট্য অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত একটি অংশ। তাদের মধ্যে একজন হলেন অভিনেতা রওনক হাসান, যিনি তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিশিষ্ট বার্তা প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল একজন মানুষ। তিনি একাই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তার আশেপাশে চুপচাপ বসে থেকে তার কথা শুনলেই মন প্রশান্তিতে ভরে যেত।’

রওনক আরও লিখেছেন, ‘এমন একজন বিশাল ব্যক্তির স্নেহের ছায়ায় আমি বড় হয়েছি, যার কাছ থেকে তিনি কৈশোরে আশীর্বাদ, স্নেহ এবং ভালোবাসা পেয়েছি। নিজের জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে সবাই চিরকালের জন্য তার অনুপ্রেরণা। আমার নাট্যগুরু, শিক্ষক, সহকর্মী ও বন্ধু, আলী যাকের।’

আলী যাকেরের নাট্যচর্চার শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই। তিনি একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বাধীনতাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর জনপ্রিয় নাটক ‘কবর’ দিয়ে তার মঞ্চে অভিনয় শুরু হয়। এরপর পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি মঞ্চে অভিনয় করে গেছেন।

তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘বিদগ্ধ রমণী কুল’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেমপেস্ট’, ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ এবং ‘গ্যালিলিও’। এই নাটকে অভিনয় করে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশেষ করে নূরলদীন, গ্যালিলিও এবং দেওয়ান গাজীর চরিত্রগুলো ছিল তাঁর অনন্য সৃষ্টি। শেক্সপিয়ার চরিত্র কিং লিয়ারের অভিনয়ের ইচ্ছা ছিল তার, তবে সেটা সফল হয়নি।

শুধুই কি অভিনয় repertoire-এ ছিল না, আলী যাকের ছিলেন একজন সফল নির্দেশকও। তাঁর নির্দেশনায় বেশ কিছু নাটক দর্শকদের মনে ব্যক্তিগত ছাপ ফেলেছে। বাংলাদেশের দর্শকদের মনে প্রথমবারের মতো ‘অর্থের বিনিময়ে নাটক দেখার ধারণা পৌঁছায় আলী যাকেরের চিন্তা থেকেই। মূলত, ‘বাকী ইতিহাস’ নাটকের মাধ্যমে তিনি এই ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশনেও তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার অভিনীত ‘আজ রবিবার’ এবং ‘বহুব্রীহি’ নাটক এখনও দর্শকদের মন জয় করে। নাটকের মান নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন নব্বই দশকের এই নাটকগুলোই বেশ আলোচিত হয়। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি লেখালেখিও করতেন, মৌলিক নাটক ও বই লিখেছেন। এছাড়াও আলী যাকের একজন শৌখিন আলোকচিত্রী হিসেবেও পরিচিত।

২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর তার শেষ মঞ্চনাটক ছিল ‘গ্যালিলিও’। নাটকের শেষের মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘সবকিছু ভুলে গেলেও এই মঞ্চের কথা আমি ভুলতে পারি না। যতবারই নাটক নিয়ে মঞ্চে উঠি, যেন নতুন করে জীবনের পুনর্জন্ম ঘটে।’ এইভাবে তার মঞ্চপ্রেম ও তার নাট্যপ্রতি আবেগ প্রকাশ পেত। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলী যাকেরের অবদান অপরিসীম। তিনি বহু বছর ধরে ক্যানসার অসুখের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কাছে হার মানতে হয়। ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে।

পোস্টটি শেয়ার করুন