রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আবারও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ক্রেমলিনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তিনি এই বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করে দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি দীর্ঘ বিরতির পর অবিলম্বে পারমাণবিক পরীক্ষা শুরু করার নির্দেশনা দেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, গত বুধবার রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সভায় পুতিন বলেন, যদি কোনো দেশ—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধের চুক্তি (সিটিবিটি) স্বাক্ষরকারী দেশ—পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়, তাহলে রাশিয়া একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে। তিনি আরও জানান, তিনি পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রাথমিক পদক্ষেপের পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর থেকে রাশিয়া এখনো পর্যন্ত কোনো পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব শক্তিগুলোর উত্তেজনা আবার বেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পুতিনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অক্টোবর মাসে পুতিনের সাথে হাঙ্গেরিতে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন, এবং তার পরদিন নতুন করে রুশ দুটি বড় তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
এর কিছুদিন পরে, ট্রাম্প বলেন, তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন অবিলম্বে পারমাণবিক পরীক্ষা শুরু করার জন্য যাতে যুক্তরাষ্ট্রও যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য বৃহৎ দেশের সমান অবস্থানে থাকতে পারে। ট্রাম্প এর আগে রাশিয়ার নতুন “বুরেভেস্তনিক” ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষার নিন্দা জানান, যা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম।
ক্রেমলিনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুতিন একাধিক অভ্যন্তরীণ পরামর্শ সভার আয়োজন করেন যেখানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রে বেলোউসোভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো রাশিয়ার জন্য বড় ধরনের আক্রমণ ও হুমকির জন্ম দিয়েছে। তিনি জানান, রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের নোভাইয়া জেমলাইয়া ঘাঁতি থেকে দ্রুত পারমাণবিক পরীক্ষায় প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব। জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ সতর্ক করে বলেছেন, “যদি এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রমের জবাব দেওয়ার সময় ও সুযোগ হারিয়ে যাবে।”
বৈঠকের পরে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস জানায়, ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভের বরাত দিয়ে বলা হয়, পুতিন কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি নির্ধারণ করেননি। তিনি বলেন, “আমরা কখন প্রস্তুতি শুরু করব, তা নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝতে কত দ্রুত সময় লাগে তার ওপর।”
বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়ার কাছে প্রায় ৫ হাজার ৪৫৯টি ওয়ারহেড রয়েছে, এর মধ্যে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ১৬০০টি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মোট ওয়ারহেডের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার ৫৫০, এর মধ্যে প্রায় ৩৮০০টি সক্ষম। স্নায়ুযুদ্ধের করোনার সময়ে, ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারহেড সংখ্যা ছিল ৩১ হাজারের বেশি।
চীন যদিও অনেক পেছনে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার পারমাণবিক শক্তির ভাণ্ডার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্টকহোম আন্তর্জাতিক পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে চীনের ওয়ারহেডের সংখ্যা প্রায় ৬০০, এবং ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে ১০০টির বেশি ওয়ারহেড বৃদ্ধি হচ্ছে। অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো হলো—ফ্রান্স, ব্রিটেন, ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়া।
১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ পারমাণবিক বিস্ফোরণ চালায়। তখন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচডব্লিউ বুশ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার স্থগিত ঘোষণা দেন। ১৯৯৬ সালে, যখন ব্যাপক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (সিটিবিটি) স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, তখন থেকে কেবল তিনটি দেশ পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। দেশগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া; তারা ১৯৯৮ ও ২০০৬ সালে বিভিন্ন সময় এ পরীক্ষা চালিয়েছে, সর্বশেষ ২০১৭ সালে। এই পরীক্ষাগুলো পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে এনেছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেননি, তার পরীক্ষার কথা—বিশেষ করে কি ধরনের পারমাণবিক পরীক্ষা করবেন—সেটি বিস্ফোরণভিত্তিক নাকি পারমাণবিক শক্তিচালিত ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা। তবে, যদি পারমাণবিক শক্তিচালিত ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা হয়, তবে ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার সেফটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহের স্থিতি পরীক্ষা করা হবে, বিস্ফোরণের প্রয়োজন হবে না।
বিশ্লেষকদের মতে, কোন দেশের পারমাণবিক পরীক্ষার শুরু বিশ্ব নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক সংকেত। জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ গবেষণা সংস্থার জ্যেষ্ঠ গবেষক আন্দ্রে বাকলিৎস্কি বলেন, ক্রেমলিনের এই প্রতিক্রিয়া অঙ্গঙ্গ ছড়াচ্ছে ‘কর্ম-প্রতিকর্ম চক্রের’ উদাহরণ, যা নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু করতে পারে। তিনি বলেন, “কেউই চাই না যে পরিস্থিতি এ রকম দাঁড়াক, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে আমরা সেদিকেই যেতে পারি।”





