এক বছরের মধ্যে রাশিয়া দাবি করেছে, তারা ইউক্রেনের প্রায় ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিজেদের দখলে নিয়েছে। এই দাবি তাদের ২০২৫ সালে ইউক্রেনে সামরিক সাফল্য অর্জনের অংশ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুতিনের দেশ এই দাবি জানানোর মাধ্যমে রাশিয়ার সামরিক অগ্রগতি ও শক্তির প্রদর্শনী করার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই দাবির মাধ্যমে মস্কো ইউক্রেনের ভেতরে সামরিক অগ্রগতি স্থাপন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার প্রভাব ফেলতে চাইছে। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) বছরের শেষ দিন এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, রুশ বাহিনী ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সিভেরস্ক এবং উত্তরাঞ্চলীয় খারকিভের ভোভচানস্ক শহরগুলো দখল করেছে। পাশাপাশি তিনি দাবি করেন, দোনেৎস্কের লাইমান ও কোস্তিয়ানতিনিভকার অঞ্চলের অন্তত অর্ধেক আর দক্ষিণে জাপোরিঝিয়া এলাকার হুলিয়াইপোলেও রুশ সেনারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব এলাকাই বর্তমানে সামনের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত।
তবে ইউক্রেনের পর্যবেক্ষকরা এই দাবির সত্যতার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। মার্কিন গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বলছে, তাদের পর্যবেক্ষণে পাওয়া বিভিন্ন উপগ্রহচিত্র ও প্রকাশিত তথ্য এই দাবি সমর্থন করছে না। তারা জানিয়েছে, সিভেরস্ক, ভোভচানস্ক এবং অন্য শহরগুলো পুরোপুরি দখলের কোনো প্রমাণ তাদের কাছে নেই। বরং শহরগুলোর কিছু অংশে রুশ সৈন্যের উপস্থিতি রয়েছে, তবে সেটি আক্রমণ বা অনুপ্রবেশের মাত্র ৭ শতাংশের বেশি নয়। এছাড়া, কোস্তিয়ানতিনিভকা এলাকায় রুশদের প্রভাব মাত্র ৫ শতাংশের বেশি নয়। এমনকি, রুশ সেনাদের দাবি অনুযায়ী লাইমানের উপর তারা সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছে, আর কোস্তিয়ানতিনিভকা তে এটি ১১ শতাংশের কাছাকাছি।
অন্যদিকে, ক্রেমলিন খারকিভের কুপিয়ানস্ক এবং দোনেৎস্কের পোক্রভস্কের দখলের কথাও বলেছে, তবে আইএসডব্লিউয়ের হিসাব অনুযায়ী এসব এলাকায় রুশবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ খুবই ক্ষেড়া মাত্রা, যথাক্রমে ৭ দশমিক ২ ও ৫ শতাংশের বেশি নয়। ইউক্রেনের সেনারা জানিয়েছেন, তারা পোক্রভস্ক এলাকা থেকে ১৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর, রুশ সামরিক বাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ সিরিজ করে বিদেশি সামরিক কর্মকর্তাদের সামনে এই বছর তাদের অর্জিত কার্যক্রমের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, যেখানে বলা হয়েছিল, রাশিয়া এই বছর ইউক্রেনের ৬ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। এর এক সপ্তাহ আগে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্দ্রেই বেলাউসোভ দাবি করেছিলেন, তারা ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছেন।
অপরদিকে, আইএসডব্লিউ অনুযায়ী, রাশিয়ার প্রকৃত দখল করা এলাকা তার সর্বোচ্চ সীমা হিসেবে ধরা হয় ৪ হাজার ৯৮৪ বর্গকিলোমিটার, যেখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১৯৬টি গ্রাম বা শহর। এর বিপরীতে রুশ কর্মকর্তারা দাবি করেন যে, তারা এই সংখ্যা ৩০০টির বেশি বসতিরও বেশি বলে বলছেন।
প্রধানত, পুতিন এই দাবি করতেই পারেন, কারণ এই দাবির মধ্যে সত্যতা রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন, সেটি হলো পূর্বাঞ্চলীয় শহর সিভেরস্কের দখল।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলছেন, আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সুদৃঢ় সহযোগিতার ভিত্তিতে তারা রাজি হয়েছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে চলা শান্তি আলোচনায় এই প্রক্রিয়া গত সোমবার শেষ হয়। জেলেনস্কি বলেন, আমরা অনুভব করছি, যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত করে শান্তি চুক্তির দিকে এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। আমাদের পক্ষ থেকেও সম্পূর্ণ সহযোগিতা রয়েছে।
তবে, ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনায় দেখা গেছে যে, সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় ‘ভূখণ্ড’ নিয়ে আরও আলোচনা ও সামঞ্জস্য হয়নি। রাশিয়া দাবি করছে, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অচিরেই ইউক্রেন থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে হবে, যার মধ্যেই ক্রিমিয়াও রয়েছে। অন্যদিকে, ইউক্রেন এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউরোপের দেশগুলো বলছে, পূর্ণ যুদ্ধবিরতির পরে ভূখণ্ড নিয়ে আলোচনা হবে।
জেলেনস্কি ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শীর্ষ এক বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন, যেখানে তারা রাষ্ট্রদুটি একসঙ্গে ভূখণ্ড বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নির্ধারণ করতে চান।
বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিচ্ছে, অর্থাৎ, ভবিষ্যতে রুশ হামলা হলে ন্যাটো যদি ইউক্রেনের পাশেই জড়ো হয়, তবে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়নও ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা আগামীদিনে ইউক্রেনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেবে, যার ফলে সেখানে আরও নিরাপত্তা ও সহযোগিতা ব্যবস্থা জোরদার হবে।
এই শান্তি পরিকল্পনার মধ্যে, ইউক্রেনের সামরিক শক্তি বজায় রাখা এবং দখলকৃত অঞ্চলের বিষয়ে রাশিয়াকে স্বীকৃতি না দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। যা ছিল মস্কোর দীর্ঘদিনের দাবি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রস্তাবের অংশ।
অবশেষে, ক্রেমলিন জানিয়েছে, তারা এই ২০ দফা পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত। বুধবার ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, তারা শিগগিরই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে নিবে এবং যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন চ্যানেল চালু থাকবে।





